যে শালিক মরে যায় || জরীফ উদ্দীন  
যে শালিক মরে যায় ||  জরীফ উদ্দীন   

আমার মা খুব অসুস্থ। মাথা ব্যথায় অস্থির। বাজার থেকে বাড়ি ফিরে মাথা কপালে হাত বুলালাম।

মা, খুব মাথা ব্যথা হচ্ছে?’ মাকে জিজ্ঞাসা করি।

হুম।

বাবাকে টাবলেট নিয়ে আসতে বলব?’

না রে। আচ্ছা তোকে একটা কথা বলি।মা অনেকটা আবদারের সুরে বলল।

বলো মা।

তোর যদি কিছু হয় আমি বাঁচব না।মা তার চোখ মোছার চেষ্টা করলেন। তার আগেই চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রæ কপল বেয়ে পরল। আমি হাত দিয়ে মুছে দিলাম। নিজের চোখের পানি সংবরণ করতে পারছি না। মায়ের মাথা টিপে দিচ্ছি।

বাবা।

হ্যাঁ মা বলো।

তুই তো কিছু বলছিস না। আচ্ছা তুই কয়েকদিন থেকে ভালো করে কিছু খাচ্ছিস না কেন? আজ সারাদিন তো কিছুই খেলি না। যা ভাত খেয়ে নে।

মা খেতে ইচ্ছে করছে না।

একটু খা না।পেটে খিদে নেই। তবুও প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধোয়া ধুয়ে ভাত নিলাম।

তোর চেহারা আয়নায় দেখছিস?’ জিজ্ঞাস করে মা শব্দ করে কেঁদে ফেলল। আমার চাঁপা কান্নাটা আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। শব্দ করেই কেঁদে ফেললাম। ঘরে শুধু কান্নার আওয়াজ। মাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলাম আমি ঠিক আছি। মা তবুও কেঁদে চলছে। ভাতে পানি ঢেলে আমার রুমে আসলাম। এসে বাতি না নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদছি। কাঁদলে নাকি মন হালকা হয়। এদিকে মা আমাকে ডাকছে ভাত খেতে। আমি জানি আজ রাতে আমার ভাত খাওয়া হবে না।

এতটুকু লিখে কলম আটকে গেল আবির মাহমুদের। তিনি খেয়াল করলেন তার চোখেও পানি। নিজেকে বুঝাতে লাগলেন এটি একটি গল্প। যার সাথে মিল নেই কোন পৃথিবীবাসীর। এমন কি কোন গ্রহবাসীরও। তাকে কষ্ট পেলে চলবে না। গল্পটা শেষ করতে হবে। সম্পাদক তাকে বেশ তাগিদ দিয়েছেন একটা ভিন্ন ধারার প্রেমের গল্প লিখতে। তারপর কি লিখবেন! তা ভাবছেন আর কলম দিয়ে দাঁতে আঘাত করছেন। হঠাৎ করে ইউরেকা বলে চিৎকার করে লেখা শুরু করলেন।

অনেক্ষণ কাঁদলাম। আজ কাল প্রতিদিন কাঁদি। ঘরের দরজা বন্ধ করে, বাথরুমে ট্যাবের পানি ছেড়ে। রাতে ঘুম হয় না আমার। ঘুমানোর চেষ্টা করা ছেড়েই দিয়েছি। নিশিকে এসএমএস দিব বলে মোবাইলে টাইপ করি। সেন্ট না করে কেটে দেই। আবার টাইপ করি। আবার কেটে দেই। এভাবে বার কয়েক চলার পর একবার এসএমএস দিয়েই ফেলি। নিশি রিপ্লে দেয়। আবার এসএমএস দেই। সে এসএমএসের আর রিপ্লে আসে না। মনের অজান্তে চোখের সামনে ভেসে আসে পুরনো স্মৃতি। কত রাত এসএমএস সেন্ট রিসিভ করতেই ভোর হয়ে গেল। আর আজ...? মানুষ কখন পাল্টে যায় তা কি আর বুঝার উপায় আছে।

আবির মাহমুদের কলম হঠাৎ আটকে গেল। তিনি ভাবছেন এভাবে নিশিকে দোষ দেওয়া কি আদৌ ঠিক। মেয়েটি যেহেতু এসএমএস দিচ্ছে না। এর কারণ তো একটা থাকতে পারে। যে আগে সারা রাত এসএমএস দিতো সে নিশ্চয় কোন কারণে এসএমএস দিচ্ছে না কিন্তু কি সেই কারণটা তিনি ভাবতে লাগলেন। সে ভাবনার কোন কুল কিনারা নাই। আচ্ছা এমনটা তো হতেই পারে নিশি এসএমএস দিতে চায় কিন্তু মোবাইলটা তার কাছে নেই। মা বাবা নিয়েছে। কিংবা মোবাইলে বালেন্স নেই। অথবা এসএমএস দেওয়ার কোন পরিবেশ নেই। এসব ভাবা বাদ দিয়ে আবির মাহমুদ আবারো লিখতে শুরু করলেন।

নিশিকে এসএমএস দিয়ে রিপ্লে না পেয়ে আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করল। একজন মানুষ আর একজন মানুষকে এভাবে ভুলে যেতে পারে তা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে খুব কষ্টকর। আমি নিশির বন্ধুদের কল দিয়ে একটু আধটু নিশিকে বুঝাতে বলি। তারা অনেকেই তার সাথে কথা বলে। কিন্তু নিশি তার সিধান্তে অটল। রাত ১২টার দিকে বাবা আমাকে ডাকে। আমি চোখ-মুখ মুছে বাবার কাছে গেলে বাবা আমাকে টাকা দিয়ে ডাক্তারকে সমাচার বলে ট্যাবলেট এবং নবরতœ তেল আর মায়ের পছন্দের সামুচা কিনে আনতে বলে। রাজারে এসে হোটেলে সামুচা পাই না। পরে বেকারীর কেক কিনে ট্যাবলেট তেল নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। বাবা মায়ের মাথায় তেল দিতে শুরু করলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ লাগল। তাদের ভালোবাসার কত গভিরত্ব! হয়তো কেউ কোন দিন কাউকে বলেনি আমি তোমাকে ভালোবাসি। অথচ দিনে কয়েক বার রুটিন করে আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেও একজন আর একজনকে কিভাবে ভুলে যায়। তা ভাবনার বিষয়। বাবা মায়ের মাথায় তেল দেওয়া শুরু করলে আমি গিয়ে শুয়ে পরি। কিছুক্ষণ পর বাবা আমাকে ডাকে। কেন ডাকে তা আমি জানি। মা হয়ত কেক খেতে বসে না খেয়ে আমাকে ডাকতে বলছে। মা যে কেন আমাকে কেন এত ভালোবাসে আমি জানি না। আমাদের পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে মাঝে মাঝে নিয়ে বেশ কথা চলে। মাকে অন্য ভাই বোনেরা কত কি বলে তবুও যেন আমার প্রতি মায়ের ভালোবাসা কমে না। আমি শুয়েই আছি ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টায়। রাতে বড় আপা আমাকে ফোন দেয়।

আপা বল।

তোর কি হইছে বলতো?’

কিছু না।

শুনলাম মা না কি খুব অসুস্থ! তুই কি মাকে মেরে ফেলবি?’ আমি জানি না এই পৃথিবীতে কাউকে বাঁচা কিংবা মারার আমি কে। নিজেই তো সেই কবে মরে গেছি। হারিয়ে ফেলেছি বাঁচার শেষ ইচ্ছা। কিন্তু আপাকে এত কিছু বলা হয় না।

কি হলো চুপ করে রইলি যে?’

আপা আমার খুব ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো। বাবাকে ফোন দিয়ে কথা বল মায়ের সাথে। রাখলাম।

দাড়াও, তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। আগে শোন তার পর ঘুমাও।

হুম, বল।

তুই কি পাগলামী শুরু করলি বলতো। পৃথিবীতে নিশি ছাড়া কি কোন মেয়ে নাই। একটা মেয়ের জন্য তুই যদি এমন করে থাকিস তাহলে কি চলবে। মেয়ে তোর কষ্ট বুঝল না। বুঝবেই বা কেমন করে! আজ কাল তো আর ভালোবাসা টাসা নাই। আর একটা কথা বড় ভাইয়া ঢাকায় বউ নিয়ে আছে। সংসারের কোন খোঁজ খবর নেয় না। আমি থাকি শ্বশুর বাড়িতে অন্যের সংসারে। বলত তুই এরকম করলে কি হবে? এখনো ছোট ভাই বোনটাকে মানুষ করতে হবে না। আর দেখ তোর খাওয়া নেই, ঘুম নেই, এলোমেলো জীবন দেখে মা অসুস্থ হয়ে পরেছে। তুই ভালো হয়ে চলতে পারিস না?’ আপার কথা আমার ভালো লাগে না। ফোনটাও রাখতে পারছি না। আপা একটু থেমে আবার বলা শুরু করলেন, ‘ কি হলো শুনতেছিস। হ্যাঁ, হু তো বলবি। আমি কাল সকালে বাড়িতে আসব তোর ভাইয়াসহ। বাড়িতে থাকিস। আমি কল কেটে দিলাম। ফেসবুকটা লগ ইন করলাম। নিশিকে এসএমএস লিখি এক ঘন্টার মতো। তার সাথে তো আজকাল কথা হয় না। মোবাইলে এসএমএস দিলেও রিপ্লে নাই। তাই একবারে সব রাগ-অভিমান অভিযোগ সব লিখে দেই। তারপর লগ আউট করে ফেসবুক থেকে বাহির হই। এতক্ষনে ফেসবুকে নিশির কোন এক্টিভিটি পেলাম না। না আসাই ভালো তাকে যে বাজে ভাষায এসএমএস লিখেছি তা তার না জানাই ভালো। না পড়াই ভালো।

আবির মাহমুদের খুব পানির তেষ্টা পায়। তিনি লেখা থামিয়ে পানি পান করার জন্য টেবিলের উপর রাখা øাসটা তুললেন কিন্তু সেখানে পানি নাই। জগটাতে নেই। তার মানে আজ পানি রেখে যায় নি। সবাই ব্যস্ত থাকে কার সময় থাকে এই আবির মাহমুদের জন্য পানি আনার। নিজেই নিজেকে বুঝান। তিনি পানি নিয়ে আসার জন্য বার্থরুমে গিয়ে আয়নায় তাকান। আয়নায় নিজের মুখ দেখে চমকে ওঠেন। তার চোখে পানি, মুখটা ফ্যাকাশে। কেমন যেন দুঃখী দুৎখী ভাব, মাথার চুল এলোমেলো, তিনিই যেন গল্পের কথক। কিন্তু কেন? সে তো কাঁদেনি। তার চোখ মুখ এমন হবার কারণ কি তা খুঁজে পেলেন না। পানি পান করতে গিয়ে বুঝতে পারেন তার তৃষ্ণা মিটছে না। পানি পান করে মনে হচ্ছে কত দিন থেকে যেন তিনি পানি পান করেন না। রুমে আসলেন। এত রাতে তার আম্মুকে ডেকে ফ্রিজের পানি পান করবেন তাও মন সায় দিল না আবির মাহমুদের। তার রুমটা বলতে ভিতরে একটা বেড, একটা চেয়ার, একটা টেবিল। টেবিলের পাশে হাজার দুই অখ্যাত-বিখ্যাত সুলভ-দূর্লভ মিলে একটা বইয়ের তাক। টেবিলের সামনে মোসালিসার একটা ছবি। ছবিটা ফারিহা তাকে দিয়েছিল তাও বছর দুই আগে। ছবির দিকে তাকাতেই ফারিহার কথা মনে পরল আবির মাহমুদের। ফারিহার সাথে একটু কথা বলা দরকার ভেবে মোবাইল বাহির করে তাকাতেই অবাক! ফারিহা তাকে কল দিয়েছে সাত বার। এসএমএস দিয়েছেন, ঘুমাবা আমাকে বলে ঘুমাবা না। তোমার কাÐ জ্ঞান হবে না! ওকে ভালো থেকো।তাও ত্রিশ মিনিট আগে। কল দিতেই রিসিভ করল ফারিহা।

লেখক সাহেব! কি খবর রাত দুইটায় কল?’

না মানে! কি করছো? ঘুমাও নি?’

না। ফেসবুক চালাই।

ওকে চালাও।

একটু কথা বলি।

হুম, বলো।

তোমার মন খারাপ না কি? আমি এতক্ষণ পড়ছিলাম। ঘুমাবো বলে কল দিলাম। তুমি রিসিভ করলা না। পরে ফেসবুকে আসলাম।

কি যে বল না! মন খারাপ থাকবে কেন!’

কণ্ঠ শুনে তাই মনে হচ্ছে।

আরে না। আচ্ছা ফারিহা, ভালোবাসার ফলাফল কী?’

তুমি তো লেখক। জ্ঞানি মানুষ। তুমি ভালো জানো। আমি জানি না কি? তবে এইটুকু বলতে পারি আমার জানটারে অনেক ভালোবাসি। অনেক।

আমার মনে হয় কি জানো? ভালোবাসা মানে হয় তুমি জয়ী হও নয়তো তাকে জয়ী কর।

কি জানি! আচ্ছা তুমি কোন পথের পথিক?’

যে নিজেকে জয়ী করবে।

পারবে তো?’

জানি না।

ওকে জানতে হবে না।

তারাতারি ঘুমাইও। আমি একটা গল্প লিখতেছি। গল্প লেখা হলে ঘুমাবো। ভালো থেক।

ওকে। আমি ঘুমাই তাহলে। পাগল একটা! সব বাদ দিয়ে লেখালেখি। তারাতারি ঘুমাইও। শুভ রাত্রি। আই লাভ ইউ জানআবিরের আর শুভ রাত্রি বলা হয় না। আই লাভ ইউ টুও বলা হয় না। কল কেটে দিয়ে রুমে পায়চারী করতে থাকেন। তাকের কাছে গিয়ে তৌহিদুর রহমানেরবসন্ত কারাগারে বারো মাসবইটা উল্টেপাল্টে গল্পটা মনে করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই বইয়ের গল্পটা মনে পরছে না। বইটা পড়তে আবার ইচ্ছে করলেও পড়ার সময় নেই। তাকে আজ গল্পটা শেষ করতেই হবে। আবির মাহমুদ আবারো লিখতে শুরু করলেন...

আমি নিশির এসএমএসের অপেক্ষায় রাত কাটাই কিন্তু নিশির কোন এসএমএস আসে না। আমাকে ছেড়ে যেতে চায়। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার অনেক কারণ আছে। আমি বেকার। বাবার সম্পতি নেই। আমাকে বিয়ে না করলে ওর ভালো ছেলে এবং ভালো ঘরে বিয়ে হবে। কেন পৃথিবীর সব মেয়েই চায় তার স্বামীর ধন-সম্পদ থাকুক, তার স্বামীর ভালো কোন চাকুরী থাকুক। সেখানে তাকেই বা দোষ দিয়ে কি লাভ! আজ বেকার সমস্যাই বড় হয়ে গেলো। আমি গরিব ঘরে জন্মেছি কিন্তু গরিব হয়ে মরতে চাই না। চেষ্টা করতেছি চাকরীর। আজ হউক কাল হউক হবে তো। সেই সময়টা নেই নিশির। সে যে সুন্দরী মেয়ে! তার যে খদ্দেরের অভাব নেই। যে কোন চাকরিজীবি বর তার জন্য ওৎ পেতে বসে আছে। নিশিরা এমন ভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা এমনই হয়। তাদের জন্ম সারা জীবন পাওয়ার জন্য কোথাও ছাড় দেওয়ার জন্য নয়।

আমি খুব কষ্টে দুই দিন কাটাই। দুইদিন পর নিশি আমার সাথে পার্কে দেখা করে। নিশিকে অনেক করে বুঝাই বুঝতে চায় না। ওর এক কথা আমাকে বিয়ে করবে না। আমাকে ভালোবাসে না। আমার থেকে দুরে থাকতে চায়। আমিও সিধান্ত নেই তার থেকে দুরে থাকব। যে আমাকে ভালোবাসে না। আমার সাথে অভিনয় করে কাটালো দীর্ঘ চার পাঁচটা বছর। আর যাই হউক তাকে ভালোবাসা যায় না। তাকে ভালোবাসা পাপ। বিয়ে করার চিন্তাটা তো অনেক দূরে। তার থেকে দুরে যেতে হবে অনেক দুরে।

আমার না কি বিয়ে। আমি মেয়ে দেখিনি। বড় আপার পছন্দে বিয়েটা হচ্ছে। মেয়ে এবং তার পরিবার আমাকে চেনে। মেয়ে নাকি আমাকে দেখেছেও কয়েক বার। তাই তারা আমাকে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। মেয়েকে দেখতে আমাকে ডেকেছিল আমি যাই নি। মেয়ের নামও শোনা হয় নি। শুধু এতটুকু শুনেছি মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সাব্জেক্টটা কি তাও শোনার আগ্রহ পাইনি। মেয়ের বাবা সরকারি চাকরী করেন। তিন ভাই এক বোন। বোনটা ছোট। দুই ভাই চাকরী করেন। এক ভাইয়ের রড-সিমেন্ট-টিনের বড় ব্যবসা। আমি বুঝি না এরকম পরিবারের মেয়েকে কেন আমার সাথে বিয়ে দিতে চায়। ঘরে মা কাঁতরাচ্ছেন অসুস্থতায়। এখানো সুস্থ হননি। আমাকে নিয়ে তার যত দুঃচিন্তা, যত স্বপ্ন, যত আশা। আমার মনে হয় আমার জন্যই মায়ের এই অসুস্থতা দিন দিন বেড়েই চলছে। আমি আমার রুম থেকে বাহির হয়ে জানালা দিয়ে মাকে একটু দেখে আসি। কাছে যাওয়ার সাহস হয় না। আমি জানি মাকে আজকের দেখাই আমার শেষ দেখা। রুমে এসে নিশিকে শেষ বারের মতো কল দেই, শেষ বারের মতো একটু কথা বলব বলে। নিশি কল কেটে দিয়ে এসএমএস দেয়,

আচ্ছা বলতো আমাকে কল দিছো কেন?’

কারণ আছে জন্য তো কল দিলাম। রিসিভ কর কথাবলি একটু।

তুমি পাগল না কি? আমি বাড়িতে। যদি কিছু বলার থাকে এসএমএস দাও।

কাল আমার বিয়ে।

বিয়ে করে ফেলো।

আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না।

সেটা তোমার ব্যাপার। আমি তোমাকে বিয়ে করছি না এটাই ফাইনাল কথা। বরং তুমি বিয়ে করে সুখী হও। আমাকে আর ফোন দিয়ে, এসএমএস দিয়ে ডিস্টার্ব করো না। আমার জন্য কোন চিন্তাও করিও না। আমি ভালো থাকব।

কিন্তু....এসএমএস আর যায় না। নিশি মোবাইলের সুইচ অফ করে রাখে। আমি এখন কি করব। মাথায় কিছুই আসে না। কয়েক রাত থেকে ঘুমের টাবলেট খেয়েও ঘুম হয় না। আমি জানি না ঘুমের টাবলেট খেয়েও কেনো ঘুম ধরে না। ইচ্ছে ছিল কয়েকটা ঘুমের টাবলেট খাওয়ার। সেটা খেয়েও কোনো কাজ হবে না। একবার মনে হলো আমার পরিবারের পছন্দেই বিয়ে করি। যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সেও তো নিশির মতোই কোন মেয়ে। কিন্তু তা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাকে তো মেনে নিতে পারব না আমার স্ত্রী হিসেবে। আমার অন্তর জুড়ে আছে নিশি। আমার প্রেমের প্রায়শ্চিত্ত কেন অন্য একটা মেয়ে ভোগ করবে। মেয়েটাকে কেন বিয়ে করে দুঃখের সাগরে ভাসাবো। আবার এমনও তো হতে পারে মেয়েটি অন্য কারো প্রেমিকা। প্রেমিককে কাঁদিয়ে বাবা মায়ের চাঁপে পরে রাজি হয়েছে কিংবা তার রাজি না হয়েই কোন পথ নাই। আসলে প্রতিটা মেয়ে সোনার চামুচ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যার ফলে কখনো তারা পরাজিত হয় না। তারা যেদিকে যাবে সে দিকটাই বিজয়।

আবির মাহমুদ লেখা থামিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আমি এত মেয়ে বিরোধী কেন? আম্মু আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। আপু তো আমাকে কলিজার টুকরা মনে করেন। ফারিহা আমাকে তার নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। সে তো আমার জন্য পাগল। অথচ এই গল্পে আমি কেন মেয়ে বিরোধী? এর উত্তর খুঁজে পান না আবির মাহমুদ। লিখতে ভালো লাগছে না তার। আবির মাহমুদ মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে লগইন করলেন। আটটি ম্যাসেজ জমা হয়েছে সবার উপরে সম্পাদকের ম্যাসেজ। উনি লিখেছেন, “আগামী কাল অবশ্যই গল্পটা পাঠাবেন নয়তো গল্পটা সংখ্যায় ছাপানো হবে না।আবির মাহমুদের ইচ্ছে হলো আর লিখবেনই না। সংখ্যায় যদি না হয় তাহলে এত রাত জাগার কি প্রয়োজন। পরক্ষণে ফেসবুক থেকে বাহির হয়ে আবার লেখা শুরু করলেন।

আমি আমার জীবনের শেষ সিধান্ত নিলাম। না আর কাউকে কোন কথা রাখা কিংবা না রাখা নয়। কারো দুঃখ-কষ্ট দেখা নয়। কারো জন্য কাঁদা নয়। কাউকে কাঁদানো নয়। কারো অসুস্থর কারণ নয়। এবার নিজেই চলে যাবো অনেক দুরে। সবার থেকে দুরে। হয়তো কেউ কাঁদবে কিংবা কেউ খুশিই হবে। আচ্ছা, আমার মৃত্যুতে বিয়ের স্বপ্নে বিভোর মেয়েটা কি খুব দুঃখ পাবে। কি জানি হয়ত খুশিও হতে পারে। মোবাইল নাম্বার থাকলে একটু কথা বলা যেত। কিন্তু মেয়েটার মোবাইর নাম্বার আমার কাছে নেই। কারো কাছে নিবো তাও সম্ভব নয়। প্রয়োজন নাই এত কিছুর। আমি ফেসবুকে গিয়ে আইডিটা নষ্ট করে দিলাম। আমি চাই না যখন আমি থাকব না ফেসবুকে আমার নাম থাকুক। কেউ চুপি চুপি আমার ফেসবুক আইডি ঘুরে আসুক। নিশিকে আমার মোবাইল থেকে শেষ এসএমএসটা লিখলাম, ‘নিশি, ভালো থেক।ফোনটা রিসেট দিলাম। ম্যামোরী ফরম্যাট দিলাম। এখন আমার জীবনের শেষ সময়। মৃত্যু পথযাত্রী বিশেষ করে ফাঁসীর আসামীকে না কি মৃত্যুর সময় জীবনের শেষ ইচ্ছে জানতে চাওয়া হয়। যা জানতে চাওয়া হয় তাই শোনা হয়। এরকম একজন ফাঁসীর আসামী যদি বলে আমার শেষ ইচ্ছা স্বাভাবিক মৃত্যু। এই ইচ্ছা পূরণ কোন দিনও হবে না। বরং ফাঁসির আসামী খেতে চাবে ডিমওয়ালা টেংরা মাছের তরকারী দিয়ে চিকন চালের ভাত। সাথে সিঁদলের ভর্তা হলেও মন্দ হয় না। সবশেষে উলিপুরের ক্ষীরমোহন। এসব কি ভাবছি আমি। আর যে সময় নেই। আমার এখন ইচ্ছে নিশির গালে একটা থাপ্পর দেয়া। সেটাও আমার দ্বারা সম্ভব নয়। যাকে ভালোবাসি তাকে কি কষ্ট দিতে পারি। আমি দরজা খুলে বাহির হলাম। বাবা-মা কথা বলতেছেন। কালকে কি করবেন না করবেন তা নিয়ে। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে ডাকলেন। আমি গিয়ে তাদের আলোচনায় যোগ না দিয়ে তারাতারি ফিরে আসলাম আমার রুমে। এসে দরজা বন্ধ করলাম। প্লাসটিকের দড়ি আগেই রাখা ছিল রুমে। একটা চেয়ার নিয়ে দড়িটা ফ্যানে বাঁধলাম। চেয়ারের উপরে দাঁড়াতেই একে একে মনে পড়তে শুরু করল সেই ছাব্বিশটা বসন্তের প্রতিচ্ছবি। আর নিশির সাথে কাটানো তিন চারটা বছরের প্রতিটা কথা, প্রতিটা ঘটনা। দড়িটা গলায় লাগিয়ে চেয়ারটা পা দিয়ে ফেলে দিলাম। চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। দড়িটা গলায় আটকে গেল একটা খিচুনি পেলাম গলায়

আবির মাহমুদ পর্যন্ত লিখে কলম থামিয়ে চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে রুমের মধ্যে পায়চারি শুরু করলেন। নিজেকে খুনি মনে হচ্ছে তার। তিনি ভাবতে পারছেন না কলমের কালো আচরের দাগে মানুষ মেরে কেন হিজিটেশনে ভুগছেন! এটাইতো প্রথম কোনো গল্পে কোনো চরিত্রের মৃত্যু নয়। অথচ তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরনার মতো প্রবাহিত হওয়া শুরু হয়েছে। তিনি সামলাতে পারলেন না অনেকটা শব্দ করে কেঁদে ফেললেন। নিজেই নিজেকে দাঁড় করালেন বিবেকের আদালতে। কি দোষ ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত ছেলেটার সে তো বাঁচতে পারত নতুন করে জীবন শুরু করে। তিনি কেন তা লিখলেন না? তিনি গল্প লিখতে পারেন বলেই কি যে কাউকে মারতে পারবেন? তাও ফাঁসি দিয়ে। এতে কি কেউ উদ্বুদ্ধ হবে না ফাঁসির মতো আত্মহনন করতে? কে নিবে এর দায়? যখন পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক দ্বন্ধ, জোড় যার মুলক তার নীতিতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, ভাই-ভাই মরছেন সামান্য স্বার্থান্ধে, চারদিকে পাপিষ্ঠের অট্টহাসি প্রতিধ্বনিত হয়, শাসক দেখা দেয় শোষক রূপে তখন এসবের প্রতিবাদে না লিখে কেন তিনি এরকম একটা নিছক প্রেমের গল্প লিখলেন যার শেষটায় চোখের সামনে কেউ একজন মারা যায় আত্মহত্যা করে। আর পাঠক কেন তার এই নিছক প্রেমের গল্প পড়বে তার ল্যবান সময় অপচয় করে? পাঠকের ন্যানোসেকেন্ড নষ্ট করার অধিকার আছে কি কোনো লেখকের? তিনি পাপবোধে ভুগতে লাগলেন। ইচ্ছে করছে তার গল্পটা ছিড়ে ফেলতে।

যথারীতি আবির মাহমুদ গল্পটা হাতে নিয়ে একটা একটা করে কাগজগুলোকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে দিলেন। ফ্যানের বাতাসে কাগজগুলো ঘুরে ঘুরে যেন তাকে উপহাস করতে লাগল, " কি বোকা মানব! নিজের সৃষ্টি নিজেই ধ্বংস করলে? জানো সবাই এই শব্দ নিয়ে খেলতে পারে না। তুমি পারো বলে লিখবে আবার ছিড়ে ফেলবে?" আবির মাহমুদ গল্পটির মায়ায় আবারো পরে গেলেন। একটু আগে যা ভেবেছেন এখন তার মনে নেই বিন্দু মাত্র। তিনি ঘোরের মাঝে আবারো চেয়ারে বসে কাগজ টেনে নিলেন। কলমটাকে বন্দি করলেন তিন আঙ্গুলে। গল্পটায় কি লিখেছেন! মনে করতে পারছেন না তিনি। তার চোখ কাগজে নয় দৃষ্টিপাত করেছে ফ্যানে। ফ্যানে ঝুলছে কোনো আবছা মানব। তিনি কাঁপতে শুরু করেছেন! কে! কে! বলে কোনো উত্তর পেলেন না। ভয়টা আরো বেড়ে গেল। তিনি মোবাইলটা হাতে নিলেন। মোবাইলের স্কিনে রিসেন্ট কল লিস্টে খুঁজতে শুরু করলেন ফারিয়ার কন্টাক্ট নাম্বার। একি রিসেন্ট কল লিস্টে তো নেই ইনবক্সেও কোনো নাম্বার নেই। অথচ কয়েক ঘন্টা আগে তো তিনি ফারিয়ার সাথে কথা বললেন। ফারিয়ার কন্টাক্ট নাম্বার লিখতে শুরু করলেন ০১৭৫৮ তারপর আর মনে পরছে না। কি আশ্চর্য! মুখস্থ নাম্বারটাও মনে নেই? মেধা তার সাথে এতো স্বার্থপরতা করতে পারে না! তিনি ইন্টারনেটের ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকতে ট্রাই করতেই আরো একবার আশ্চার্য হলেন। ইউজার নেম পাসওয়ার্ড রিমেম্বার করা থাওলেও তিনি লগ ইন করতে পারছেন না। ইউজার নেম পাসওয়ার্ড শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারছেন না। তার ফোনে কি হলো? তিনি চোখ বন্ধ করলেন। এবার মনে পরেছে। গল্পটা লিখতে তিনি নিজেই তার ফোন রিসেট এন্ড রিস্টার্ট দিয়েছেন যার ফলে ফোনের সকল তথ্য মুছে গেছে। তিনি নিজের চুল নিজেই ছিড়ছেন। চোখ খুলে ফ্যানের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলেন। ছায়া মানব তার সামনের টেবিলেই শুয়ে আছেন। তিনি চিৎকার দিয়ে চেয়ার থেকে লাফিয়ে পিছিয়ে গিয়ে দোড় দিতে গিয়ে বুঝতে পারলেন তার পা কে যেন টেনে ধরেছে। চিৎকার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আচ্ছে কানে। পুরো ঘটনা তার কাছে মনে হল স্বপ্ন।

আবির মাহমুদ কি যেন ভাবলেন। তারপর ঘরের কোনে রাখা দড়ি হাতে নিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে চেয়ার টেনে ফ্যানের কাছে গিয়ে দড়িটা ফ্যানে আটকালেন। হ্যাঁ এবার মনে পরছে গল্পটা। গল্পের শেষ লাইনগুলো ছিলো অনেকটা এরকম! গল্পের নায়ক ফ্যানে ফাঁসি দিয়েছিলেন তার প্রিয়তাকে না পাওয়ার বেদনায়। তিনি হুবহু তাই করতে শুরু করলেন। এবার পুরো গল্পটা মনে পরেছে। গল্পটার প্রথমের দিকে নায়কের মা অসুস্থ.......... নায়িকা নিশি...... ফারিহার মোবাইল নাম্বারটাও মনে পরছে। মোবাইলটা হাতেই ছিল তিনি ফারিহার নাম্বারে ডায়াল করার জন্য তুলছেন ০১৭৫৮২....ততক্ষণে তার গলায় টান অনুভব করতেই তিনি বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করছেন। মোবাইলে রিং হচ্ছে। হঠাৎ করে হাত থেকে মোবাইলটা পরে গেল। তিনি দড়ির আগ্রাসী থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হাত ওপরে ওঠানোর চেষ্টা করে বুঝতে পারলেন কে যেন হাতটা টেনে ধরেছে। তাকে যে বাঁচতে হবে। অথচ মৃত্যু অনিবার্য তার। তিনি আবারো চিৎকার শুরু করলেন " বাচাও, বাচাও!" সে চিৎকার কোথায় যে হারিয়ে যায় আবির মাহমুদ নিজেই বুঝতে পারেন না। এক সময় ভুলে যান তার অতীত-বর্তমান। নিজের অবচেতন মনের অনিচ্ছায় মুখ থেকে অস্ফুট শব্দে বাহির হয় আবির মাহমুদের

নিশি, ভালো থেক। শালিকেরা বাঁচে না! নদী তীরে তারা যতই কিচিমিচি করুক না কেন তাদের মৃত্যু অনিবার্য। তাদের ইশতেহার এরকম ভাবেই লেখা থাকে।

 

 





সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান